আশুরা সম্পর্কিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলি |


ইতিহাসের পাতায় কিছুদিন এমন আছে, যেগুলোর গুরুত্ব শুধু কালের ধারায় নয়, বরং আসমানি বরকত, নবুয়তের স্মৃতি, আখলাকি শিক্ষা এবং ঐশী ব্যবস্থার নিদর্শন হিসেবে অক্ষয় হয়ে আছে। এসব দিবসের মধ্যে এক অনন্য মহিমাময় দিন হলো আশুরার দিন, অর্থাৎ মহররম মাসের দশম দিন।


এই দিনটির মাহাত্ম্য এতই বিস্তৃত যে যুগে যুগে নবী-রাসুলদের জীবন, মানবতার দিশা, তাওবার কবুলিয়ত এবং সত্য-মিথ্যার চূড়ান্ত ফায়সালাও এই দিনেই ঘটেছে। তবে হ্যাঁ, আশুরা সম্পর্কিত ঐতিহাসিক সব বিবরণ সূত্রগতভাবে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হয়নি।


তবে ইতিহাসের নানা গ্রন্থে এসব ঘটনা নিয়ে বর্ণনায় থাকায় এসব ঘটনার ঐতিহাসিক ভেল্যু আছে—তা বলাই বাহুল্য। নিম্নে ইতিহাসের সেই চিরজাগরূক দিবসটির তাৎপর্য ও ঘটনাবলি সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো—


১. সৃষ্টির সূচনা : আশুরার দিনেই সৃষ্টি হয় আসমান-জমিনের, কলম এবং মানবজাতির পিতা আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়।


২. আদম (আ.)-এর তাওবা কবুল : ভুলের পর অনুতপ্ত হৃদয়ে আদম (আ.) আল্লাহর দরবারে ফিরে আসেন, আর এই দিনেই তাঁর তাওবা কবুল হয়।


৩. ইদ্রিস (আ.)-এর উত্থান : আশুরার দিনেই ইদ্রিস (আ.)-কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়।


৪. নুহ (আ.)-এর নৌকার পরিত্রাণ : সৃষ্টির ইতিহাসের ভয়াবহতম প্লাবনের সময় নুহ (আ.)-এর জাহাজ এই দিনেই নিরাপদে কূলে ভেড়ে এবং জুদি পাহাড়ে অবস্থান নেয়।


৫. ইবরাহিম (আ.) ‘খলিলুল্লাহ’ হন : এই দিনেই ইবরাহিম (আ.)-কে ‘খলিলুল্লাহ’ (আল্লাহর প্রিয়তম বন্ধু) উপাধিতে ভূষিত করা হয় এবং তাঁর জন্য আগুন পরিণত হয় শীতল ও নিরাপদ ফুল বাগিচায়।


৬. ইসমাইল (আ.)-এর জন্ম : আশুরার দিনেই জন্মগ্রহণ করেন ত্যাগ ও কোরবানির প্রতীক ইসমাইল (আ.)।


৭. ইউসুফ (আ.)-এর মুক্তি : মিসরের অন্ধকার কারাগার থেকে এই দিনেই মুক্তি পান ইউসুফ (আ.) এবং পেয়ে যান রাজসিংহাসনের সম্মান।


৮. ইয়াকুব (আ.) ও ইউসুফ (আ.)-এর মিলন : দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর এই দিনেই বাবা-ছেলের পুনর্মিলন ঘটে; আনন্দের অশ্রু আর ভালোবাসার আলিঙ্গনে।


৯. মুসা (আ.) ও বনি ইসরাঈলের মুক্তি : ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তির সেতু তৈরি হয় এই আশুরার দিনে। লাল সাগর চিরে পথ তৈরি হয়, আর জালিম ফেরাউন তার সঙ্গীদের নিয়ে সলিল সমাধি লাভ করে।


১০. তাওরাতের নাজিল : মুসা (আ.)-এর প্রতি আল্লাহর কিতাব ‘তাওরাত’ এই দিনেই নাজিল হয়।


১১. সুলাইমান (আ.)-এর রাজত্ব ফিরে পাওয়া : কিছু সময় রাজত্ব থেকে বঞ্চিত থাকার পর সুলাইমান (আ.) পুনরায় রাজসিংহাসনে বসেন এই দিনে।


১২. আইয়ুব (আ.)-এর রোগমুক্তি : কষ্টে আর ধৈর্যে ভরা এক দীর্ঘ পরীক্ষার পর আইয়ুব (আ.)-কে তাঁর কঠিন রোগ থেকে আরোগ্য দান করা হয় এই দিনেই।


১৩. ইউনুস (আ.)-এর মুক্তি : ৪৪ দিন মাছের উদরে অবস্থান করে অবশেষে মুক্তি লাভ করেন ইউনুস (আ.) এই আশুরার দিনেই।


১৪. ইউনুস (আ.)-এর জাতির তাওবা কবুল : এই দিনে ইউনুস (আ.)-এর জাতি তাওবা করে এবং আল্লাহর গজব থেকে রক্ষা পায়।


১৫. ঈসা (আ.)-এর জন্ম : এই পবিত্র দিনে জন্মগ্রহণ করেন ঈসা (আ.)।


১৬. ঈসা (আ.)-এর উত্তোলন : এদিনেই আল্লাহ তাআলা তাঁকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করে আসমানে উঠিয়ে নেন।


১৭. প্রথম বারি-রহমত : এই দিনেই পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো রহমতের বৃষ্টি নেমেছিল।


১৮. কাবার নতুন গিলাফ পরিধান : কুরাইশ গোত্রের লোকেরা প্রতিবছর এই দিনে কাবা শরিফে নতুন গিলাফ পরাতেন।


১৯. খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে নবিজি (সা.)-এর বিবাহ : এই মহান দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন উম্মুল মুমিনিন খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে।


২০. কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা : এই আশুরার দিনেই কুফার বিশ্বাসঘাতকরা শাহজাদা হুসাইন (রা.), নবীজির (সা.) প্রিয় নাতি এবং ফাতেমা (রা.)-এর নয়নমণিকে নির্মমভাবে শহীদ করে। কুফার রক্তাক্ত প্রান্তরে সত্য, সাহস ও ত্যাগের ইতিহাস রচিত হয়।


২১. কিয়ামতের দিন : হাদিসসমূহের আলোকে অনেক আলেমের অভিমত, কিয়ামতের ভয়াবহ দিনটিও হবে এই আশুরার দিনেই। (নুজহাতুল মাজালিস, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৪৭-৩৪৮, মাআরিফুল হাদিস, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা : ১৬৮)


লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক





Source from Bangladesh Pratidin