মন্ত্রী সচিব এজেন্সি পুলিশ সিন্ডিকেট |


মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার নষ্টের নেপথ্যে মন্ত্রী, সচিব, এজেন্সি এবং পুলিশের কয়েকজনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। শ্রমবাজার নিয়ে সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকা পাচারে সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনসহ ১০৩ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এদিকে ওই ১০৩ জনের মধ্যে সাবেক এমপি লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক রুহুল আমিন স্বপন, সাবেক এমপি বেনজির আহমেদ ও নিজাম উদ্দিন হাজারীর বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে সিআইডিকে মালয়েশিয়ার তদন্ত সংস্থাও অনুরোধ জানিয়েছে। তবে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পল্টন থানায় করা মানব পাচারের মামলা সূত্রে শ্রমবাজার নষ্টের নেপথ্যের তথ্য বেরিয়ে আসে। মামলাটি করেন আফিয়া ওভারসিজের মালিক আলতাব খান। এর প্রায় ২০ দিনের মাথায় মানব পাচারের অভিযুক্ত হয়ে তিনি নিজেই মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ায় গ্রেপ্তার হন। এদিকে তার ভুল মামলা রেকর্ড ও পরবর্তী পদক্ষেপে প্রক্রিয়াগত ভুলের জন্য এসআই, পরিদর্শক ও এসপিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সিআইডি পুলিশ সদরদপ্তরে চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে।


জানা যায়, প্রথমে মামলাটি তদন্ত করেন পল্টন থানার এসআই নাজমুল ইসলাম। পরে তদন্ত স্থানান্তরিত হলে গত ১৭ জুলাই মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন সিআইডি পরিদর্শক মো. রাসেল। তিনি জানান, তদন্তে যা পাওয়া গেছে সেই মোতাবেক প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।


জানতে চাইলে সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ বদরুল আলম মোল্লা বলেন, মামলাটির প্রক্রিয়াগত ভুল ছিল। এখানে চাঁদাবাজি ও মানব পাচারের কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি। তবে মামলায় যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের বিষয়ে মানি লন্ডারিংয়ে অভিযোগে তদন্ত চলমান রয়েছে। আর যারা মামলাটির প্রক্রিয়াগত ভুলে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।


সূত্র জানায়, মামলাটিতে তথ্যগত উপাদান না থাকলেও তা রেকর্ড করেন পল্টন থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মো. নাসিরুল আমিন। ওই মামলায় শুধু গ্রেপ্তার হন সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ। অথচ প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম সব আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে জানিয়ে মালয়েশিয়া সরকারের কাছে চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি ওই দেশের ইমিগ্রেশনের সফটওয়্যার ‘এফডব্লিউসিএমএস’ বাংলাদেশিদের জন্য বন্ধেরও আবেদন করেন। এই চিঠি ওসির মাধ্যমে পুলিশ সদরদপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি আলী হায়দার চৌধুরীর কাছে পাঠানো হয়। তিনি তা সরাসরি মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এসব চিঠি পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) মাধ্যমে মন্ত্রণালয় ঘুরে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল। এই প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করায় ওই তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশ সদরদপ্তরে চিঠি দিয়েছে সিআইডি। এ বিষয়ে জানতে এআইজি (এনসিবি) আলী হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর আলোচিত ‘কাউন্টার সেটিং’ সিন্ডিকেটের এজেন্ট সন্দেহে আলতাব খানকে গ্রেপ্তার করে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয়।


অভিযোগ রয়েছে, তিনি সিন্ডিকেটের আওতায় দেশটির বিমানবন্দরে কর্মরত কিছু অসাধু ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে বাংলাদেশি কর্মীদের নির্বিঘ্নে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার ব্যবস্থা করেন। পল্টন থানা সূত্র জানায়, সিন্ডিকেট করে চাঁদাবাজি, অর্থ আত্মসাৎ ও মানব পাচারের অভিযোগে সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদ এবং একই মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ মোট ১০৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন আলতাব খান। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৩ সাল পর্যন্ত কর্মী হিসেবে মালয়েশিয়ায় গেছেন প্রায় ৪ লাখ ৭৬ হাজার। এর বাইরে সময় মতো ফ্লাইট না পেয়ে যেতে পারেননি আরও ১৭ হাজার। এদের মধ্যে প্রায় ৯ হাজার আবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে গেছেন। এরা মালয়েশিয়ায় যেতে গড়ে ৫ লাখ টাকা করে এজেন্সিকে দিয়েছেন। এসব ব্যক্তিদের মালয়েশিয়ায় পাঠাতে টাকা নেওয়া এবং ভিসা সংগ্রহ করে দেওয়ার কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত প্রায় ৫ হাজার বৈধ ও অবৈধ এজেন্ট। আর ভিসা আনা এবং অনুমোদনে সম্পৃক্ত অন্তত ১০০ জন।


মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলাটির একটি ধারায় চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু চাঁদা নেওয়ার কোনো দিন তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। যে অফিস থেকে চাঁদা দাবি করা হয়েছে সেখানে সিসিটিভি ফুটেজ থাকলেও তা সরবরাহ করা হয়নি। আর কী পরিমাণ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছিল, আর কারা কারা চাঁদা নিতে গিয়েছিল তাও উল্লেখ নেই। মামলায় মানব পাচারের আরেকটি অভিযোগ করা হয়। মানব পাচারের অপহরণের পর ভয়ভীতি দেখিয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা আদায়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো ভুক্তভোগী কোথাও কোনো মামলা বা অভিযোগ করেননি। এ ছাড়া মালয়েশিয়াতে লোক পাঠানোর নামে ২৪ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত নিয়ে আত্মসাৎ হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। এই হিসাব ধরলে দেখা যায়- যারা গেছে তারা জনপ্রতি প্রায় ৫ লাখ টাকা দিয়ে গেছে। কিন্তু দিয়ে কেউ গেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়নি। সিআইডি সূত্র জানায়, ব্যক্তিগত কারণে ১০৩ নম্বর আসামি সানজারি ইন্টারন্যাশনালের মালিক শেখ আবদুল্লাহকে ফাঁসাতে এমন ভুয়া মামলা করা হয়।


বিডি প্রতিদিন/নাজমুল





Source from Bangladesh Pratidin