২৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে ধরা পড়ছে ভয়াবহ লুটপাট |


আওয়ামী সরকারের আমলে নেওয়া তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করতে গিয়ে বিস্মিত এ নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। ২৫ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্পে ধরা পড়ছে ভয়াবহ লুটপাট। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পেও হয়েছে হরিলুট। তদন্তর কাজ এখনো চলছে। এরই মধ্যে সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের মেয়াদ আরও দুই মাস বাড়ানো হয়েছে। আগামী ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত এবং শ্বেতপত্র সরকারের কাছে জমা দেবে টাস্কফোর্স। গতকাল তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘কাজের অগ্রগতি দারুণ। সব প্রকল্পের বিস্তারিত অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছে টাস্কফোর্স। কাজের অগ্রগতি জেনে প্রধান উপদেষ্টা এর মেয়াদ আরও দুই মাস বাড়িয়েছেন। আশা করি ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে টাস্কফোর্স শ্বেতপত্র জমা দিতে পারবে।’


সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থ লুট করতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে নেওয়া হতো নানা প্রকল্প। শেখ পরিবারের নামে গত ১৫ বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে ৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতেই ওই পরিবারের নামে নেওয়া হয় ১১টি প্রকল্প। যার আর্থিক মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ খাতের


যে কোনো প্রকল্পে শেখ পরিবারের নাম থাকলেই অনেকটা বিনা শর্তে পাস করানো হতো। বাজেটের বিষয়েও দেখানো হতো উদারতা। দফায় দফায় বাড়ানো হতো প্রকল্পের বাজেট। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে শেখ পরিবারের নামে থাকা প্রকল্পগুলোর অডিটে ছিল নিষেধাজ্ঞা। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও এসব তথ্য উঠে এসেছে।


এসব প্রকল্পের কাজ সরাসরি তত্ত্বাবধান করেন সাবেক দুই মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও জুনাইদ আহমেদ পলক। ১১টি প্রকল্পের বেশির ভাগেরই কয়েক দফা প্রকল্পমূল্য বাড়ানো হয়। খরচের ক্ষেত্রে মানা হয়নি নিয়মকানুন। শেখ পরিবারের নামে প্রকল্প হওয়ায় কেউ কোনো প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। এসব প্রকল্পের প্রয়োজন নেই বলে কিছু কর্মকর্তা প্রশ্ন তুললে তাঁদের আওয়ামীবিরোধী বলে ট্যাগ লাগানো হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁদের কপালে জুটেছে বদলি, তাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন পদোন্নতি থেকে। এ ধরনের প্রায় ২৫ জন কর্মকর্তা রয়েছেন বলে জানিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ। শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে নেওয়া প্রকল্পের মধ্যে ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, হাই-টেক পার্ক, শেখ কামালের নামে আইটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউটসহ আরও কয়েকটি প্রকল্প। সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতে শেখ পরিবারের নামে নেওয়া সব প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক খরচ বাদ দেওয়া হয়েছে।


এদিকে বিগত সরকারের আমলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতে নেওয়া ২৫ হাজার কোটি টাকার ২১ প্রকল্প নিয়ে করা তদন্তেও উঠে আসছে ভয়াবহ লুটপাটের চিত্র। এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তাঁরা জানান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ, বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের নেওয়া প্রকল্পগুলো উদ্দশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং অপ্রয়োজনীয় বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কতিপয় কার্যক্রম তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে অর্থের অপচয় করা হয়েছে। বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন ও অন্যান্য নির্মাণ প্রকল্পে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ করায় কেনা বাবদ অর্থের অপচয়, অধিক ভূমি উন্নয়ন ব্যয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রশস্ত, অতিরিক্ত উচ্চ ও অতিরিক্ত অবকাঠামো (যথা আইটি ট্রেনিং সেন্টারে গুদাম নির্মাণ) করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থের অপচয় করা হয়েছে।


এসব প্রসঙ্গে সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টাস্কফোর্স ২১টি প্রকল্পের বাইরেও আগের নেওয়া প্রকল্পগুলোও খতিয়ে দেখছে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বাইরের মন্ত্রণালয়ের জন্য নেওয়া প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো বিস্তারিত তদন্ত করা হচ্ছে। পরামর্শক, ঠিকাদার, সরবরাহকারীসহ বিভিন্ন প্রকল্পের উপকারভোগীদের সঙ্গেও কথা বলছে টাস্কফোর্সের সদস্যরা। তিনি বলেন, খুব সুন্দর কাজ করা হচ্ছে, বলা যায় খুবই গোছানো কাজ। চোর ধরার পাশাপাশি সার্বিক অনিয়ম ও দুর্নীতিটা ধরাও এখানে বড় কাজ। তদন্ত শেষে শ্বেতপত্রে টাস্কফোর্স তাদের নিজেদের মূল্যায়ন ও সুপারিশও তুলে ধরবে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ১৭ এপ্রিল টাস্কফোর্স গঠনের গেজেট প্রকাশিত হয়। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন প্রফেসর মুহাম্মদ মুস্তাফা হোসেন, আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আফজাল জামি সৈয়দ আলী, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মাহমুদ সালাম মারুফ, সাংবাদিক মো. শরিয়ত উল্যাহ। এ ছাড়া প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে রয়েছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আসিফ শাহরিয়ার সুস্মিত। টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি সম্পর্কে গেজেটে বলা হয়, আইসিটি খাতে অনিয়ম এবং অপব্যবস্থাপনার তদন্ত এবং আইসিটি শ্বেতপত্র প্রকাশের নিমিত্তে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভাগের বিগত সরকারের সময়ে সম্পাদিত সব ধরনের চুক্তি এবং প্রকল্পের ডিপিপি, সব অডিট রিপোর্ট ও তদন্ত প্রতিবেদন খতিয়ে দেখবে এই টাক্সফোর্স। টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, আইসিটি খাতে অনিয়ম এবং অপব্যবস্থাপনার তদন্ত এবং আইসিটি শ্বেতপত্র প্রকাশের পাশাপাশি বিগত সরকারের সময়ে সম্পাদিত সব ধরনের চুক্তি এবং প্রকল্পের ডিপিপি, সব অডিট রিপোর্ট ও তদন্ত প্রতিবেদন খতিয়ে দেখবে এই টাস্কফোর্স।



বিডি প্রতিদিন/নাজমুল





Source from Bangladesh Pratidin