ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি বৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত বছরের ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু সেই সরকার পুরোপুরি তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। সংবিধান, গণমাধ্যম, শ্রম, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসনসহ গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বেশির ভাগ সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়নি।
শুধু তা-ই নয়, সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য স্থাপন করতে না পারায় জাতির সামনে জুলাই সনদ উপস্থাপন করতে পারেনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে আলোচ্য সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। যেটিকে এই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ৫ আগস্ট মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে জুলাই ঘোষণাপত্রও উপস্থাপন করেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর উপলক্ষে ১২টি ‘অর্জনের’ কথা তুলে ধরে গতকাল সকালে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। ফেসবুক পোস্টে তিনি জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের সহায়তা, আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধার, নির্বাচন পরিকল্পনা ও সংস্কারের মতো বিষয়ে সরকারের অর্জন তুলে ধরেন। এ ছাড়া জুলাই বিপ্লবের পর দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরেছে দাবি করে শফিকুল আলম বলেন, ‘যার ফলে নৈরাজ্য ও প্রতিশোধের চক্র বন্ধ হয়েছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নৈতিক নেতৃত্ব ছিল এই স্থিতিশীলতার মূল চালিকাশক্তি, যা জাতিকে সহিংসতা নয়; বরং পুনর্মিলন ও গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করেছে।’
প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারের কাছে জাতির আশা আরও বেশি ছিল, তবে সরকার যথাযথ সময় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বিভিন্ন সময়ে ব্যর্থ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, সেগুলো নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনকে প্রধান উপদেষ্টার চিঠি পাঠানোকে এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ উল্লেখ করে সালাউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, জাতি এর জন্যই অপেক্ষা করছিল।
অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশাসন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের অর্জন নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তাদের মতে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে প্রত্যাশামাফিক স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়নি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ সহিংসতা (মব ভায়োল্যান্স) ও রাজনৈতিক বিরোধ বেড়েছে। অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া আহতদের যথাযথ চিকিৎসা সহায়তা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। এমনকি আহত ও শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে না পারার দায়ও দিচ্ছে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব ফয়সাল মাহমুদ শান্ত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তি দুটোই আছে। হতাশার দিক হলো, সরকার আহত ও শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন এবং তাদের পরিবারকে পুনর্বাসন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার তেমন উন্নতি ঘটাতে পারেনি। প্রাতিষ্ঠানিক যেসব সংস্কার আশু ভিত্তিতে করা দরকার ছিল, তা করতে পারেনি। তিনি বলেন, এই সরকারের কিছু সাফল্যের জায়গাও রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর, দেশের মানুষের উদ্বেগ ছিল যে ইস্যুগুলোতে বিশেষ করে ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিপর্যস্ত বাণিজ্য, বাজারব্যবস্থা, চাঁদাবাজ-সিন্ডিকেট, মব-ভায়োলেন্স, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা- এসব ক্ষেত্রে প্রত্যাশা অনুযায়ী অগ্রগতি ঘটেনি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও মূল্যস্ফীতি ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক এখনো নিম্নমুখী; ব্যাপকভাবে আস্থার সংকটে ভুগছে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য; দেশিবিদেশি বিনিয়োগেও কাঙ্ক্ষিত গতি নেই; উপরন্তু ব্যবসা পরিচালনা করতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে; বেড়েছে বেকারত্ব; নতুন কর্মসংস্থান হয়নি; কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির যে সমন্বিত পদক্ষেপ- গত এক বছরে সেটিও দেখা যায়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের দফায় দফায় সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ কমতে কমতে ৬ থেকে ৭ শতাংশের ঘরে নেমে গেছে। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। তাঁদের কথা সরকারের কেউ শুনছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে খোদ ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেই। শুধু তা-ই নয়, ভুয়া মামলা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলবসহ, হুমকিধমকি ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে দেশের ব্যবসা খাতে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যে ব্যবসায়ীরা এখন অনেকেই তাঁদের ব্যবসাবাণিজ্য থেকে বের হয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও বলছেন, সুুশাসন কায়েম করতে সরকারের লক্ষ্য ছিল জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ ও পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার। গত এক বছরে তাতেও অগ্রগতি নেই; বরং সরকারের কিছু সিদ্ধান্তে জনপ্রশাসনে বিভেদ বেড়েছে। পুলিশ ও বিচার বিভাগের অস্থিরতাও কমেনি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংস্কার কার্যক্রম দেখা যায়নি। কমিশন করে সুপারিশ গ্রহণের পরও গণমাধ্যম, শ্রম ও নারী বিষয়ে সংস্কার কার্যক্রম আটকে গেছে। বিগত আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের মতোই স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধাগ্রস্ত হয়েছে গণমাধ্যম। হুমকিধমকি ছাড়াও জাতীয় দৈনিক দখলের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে টিআইবি বলেছে, ‘গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোতে মব তৈরি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। সাংবাদিক, লেখক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর হামলা ও হয়রানির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মালিহা নামলাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গণ অভ্যুত্থানের পর আমরা একটা বিপ্লবী সরকার গঠন করতে পারি নাই। বর্তমান সরকার অন্তর্বর্তী নির্বাচনি সরকার। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান হয়েছে, তা এই সরকারের পূরণ করার সক্ষমতা নেই। গণহত্যার বিচার, জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতিসহ নানাবিধ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি এই সরকার দেখাতে পারেনি।’